মাত্র সাত বছরের আহমদ ইসলাম মাহি চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে তার বাবা মাসুদুর রহমান জনিকে হারিয়েছে। এখনো বাবাকে খুব মনে পড়ে তার। মা অনেক আগেই তার বাবার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ায় বাবাই ছিল মাহির একমাত্র আশ্রয়।
পরিবারের সদস্যরা জানান, কয়েক বছর আগে মাহির মা-বাবার বিচ্ছেদ হয় । এরপর থেকে বাবার আদর-স্নেহেই বড় হচ্ছিল মাহি। বাবার ভালোবাসার কারণে সে কখনো মায়ের অনুপস্থিতি টেরই পায়নি।
কিন্তু এক গুলি মাহিকে পুরোপুরি নিঃস্ব করে দেয়। মা-বাবা দুইজনেরই স্নেহছায়া থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয় সে।
৩৮ বছর বয়সী জনি পেশায় ছিলেন গাড়ির যন্ত্রাংশ ব্যবসায়ী। ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে পুলিশ ব্যারিকেড ভেঙে ‘মার্চ টু ঢাকা’য় যোগ দিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে আয়োজিত ঐতিহাসিক কর্মসূচিতে অংশ নিতেই তিনি সেখানে গিয়েছিলেন।
‘আমার আব্বু আমাকে প্রতিদিন মাদ্রাসায় নিয়ে যেত আর বাসায় নিয়ে আসত। চকলেট, বিস্কুট, চিপস এনে দিত। এখন আব্বুকে খুব মনে পড়ে।’ ঢাকার কনাপাড়ায় ভাড়া বাসায় বসে এভাবেই নিজের কষ্টের কথা বলছিল স্থানীয় এক কওমি মাদ্রাসার ছাত্র মাহি।
অন্য শিশুদের বাবার আদর পেতে দেখে ফাঁকা চোখে তাকিয়ে থাকে মাহি। বাবার সঙ্গে কাটানো ছোট ছোট মুহূর্তগুলো আজীবন তার মনে পড়বে।
কোনো বাবার কোলে সন্তান দেখে হয়তো নিজের ফেলে আসা শৈশবের স্মৃতি হাতড়ে ফিরবে সে। এখন নানি জান্নাতে নূর মোমেনার (৬৮) সঙ্গে ওই ভাড়া বাসায় থাকে মাহি। চাচারা দেখভাল করছেন তাদের।
মোমেনা বলেন, ‘ওর মা তো অনেক আগেই ওকে ছেড়ে চলে গেছে। বাবা-ই ওকে বড় করেছে। এখন ওর মা ফোন করলেও মাহি কথা বলতে চায় না।’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মোমেনা।
নিজের শহীদ সন্তান সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি মোমেনা। শুধু বললেন, ছেলের কথা মনে হলেই তিনি জ্ঞান হারান।
মর্মান্তিক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তৌহিদুল হাসান রিয়ন জানান, ৫ আগস্ট সকাল ১০টা ৩০ মিনিট থেকে ১১টার মধ্যে জনি যাত্রাবাড়ীতে বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দেন। ঐতিহাসিক ‘মার্চ টু ঢাকা’র অংশ হিসেবেই সেখানে গিয়েছিলেন তারা।
রিয়ন বলেন, ‘শুরু থেকেই আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে ছিলাম। জনি আর আমি একসঙ্গেই আন্দোলনে যোগ দিতাম। ৪ আগস্টও একসঙ্গে মিছিলে ছিলাম।’
৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ৯টার দিকে যখন তারা শাহবাগ অভিমুখে যাত্রা করেন, তখন যাত্রাবাড়ীতে প্রবেশের মুখে পুলিশ ব্যারিকেড দেয়।
‘সেদিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল। ঠিক তখনই যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ আমাদের ওপর গুলি চালায়। কাজলা পেট্রোল পাম্পের কাছে তিনজন মাদরাসাছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয়,’ স্মৃতিচারণ করেন রিয়ন।
তিনি বলেন, ‘যাত্রাবাড়ী থানা ভবনের সামনে দিয়ে ঢাকায় ঢোকার চেষ্টা করতেই ডান পাশে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গুলি চালায়। আর সামনেই পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করে।’
‘দুপুর ১২টা ৩০ থেকে ১টার মধ্যে ছাত্র-জনতার ব্যানারে আমরা যখন আবার যাত্রাবাড়ী পার হওয়ার চেষ্টা করি, তখন ডান পাশে যাত্রাবাড়ী স্টোরহাউসের সামনে জনি-সহ চার-পাঁচজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।’
পুলিশ কিছুক্ষণ গুলি বন্ধ রাখলে তারা লাশ উদ্ধার করে রিকশাভ্যানে করে বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠান বলে জানান রিয়ন। রিয়ন বলেন, ‘সেদিন বিকাল ৫টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে। সারা দিন আমাদের কাজ ছিল লাশ উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো।’
‘সকাল থেকে দুপুর আর দুপুর থেকে সন্ধ্যা—এই দুই দফায় আমরা নিজেরাই ৭০টি মরদেহ উদ্ধার করেছি যাত্রাবাড়ী থেকে। তবে নিহতের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি।’
জনির বড় ভাই আবু সাঈদ বলেন, ‘বিকেল ৩টার দিকে বিজয় মিছিলে থাকা অবস্থায় জনির এক বন্ধু ফোন করে জানায়, জনি গুলিবিদ্ধ হয়েছে।’
তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন, সামান্য আঘাত পেয়ে থাকতে পারে। ‘কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আবার ফোন আসে, জনি আর নেই। লাশ রাখা হয়েছে মিটফোর্ড হাসপাতালে।’
মিটফোর্ডে যেতে গিয়ে পুলিশের বাধা আর নির্বিচার গুলির মুখে পড়তে হয় জানিয়ে সাঈদ বলেন, ‘যাত্রাবাড়ী থেকে পুরান ঢাকার রায় সাহেব বাজার মোড় পর্যন্ত সর্বত্র পুলিশ গুলি চালাচ্ছিল।’
'রায় সাহেব বাজার মোড়ে পৌঁছার পর খালাতো ভাই ফোন করে জানায়, তারা জনির লাশ বাসায় নিয়ে গেছে।’ সেদিন রাত ১১টায় হাসপাতাল থেকে পাওয়া টোকেন দেখিয়ে আজিমপুর কবরস্থানে জনিকে দাফন করা হয়।
জনির পরিবার তার হত্যাকাণ্ডের বিচার ও দায়ীদের ফাঁসি দাবি করছে। 'আমরা শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদেরসহ ২২ জনকে আসামি করে মামলা করেছি।’ বলেন আবু সাঈদ। তিনি জানান, ৯ জানুয়ারি পুলিশ কবর থেকে মরদেহ তুলে ময়নাতদন্ত করেছে।
মন্তব্য করুন