শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫, ২৮ চৈত্র ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিঅন্যান্যসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫, ২৮ চৈত্র ১৪৩১

‘গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও দেখি ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা শহীদ আবু সাঈদকে পেটাচ্ছে’

নিজস্ব প্রতিবেদক
  ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩:০৮
ছবি-সংগৃহীত

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ১৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে আহত মাহবুব আল-হাসান মুন (২১) এখনও শরীরে ১৫০টি গুলি বহন করে চলেছেন। 

জরুরি ভিত্তিতে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন হলেও পারিবারিক আর্থিক সংকটের কারণে এখনও তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শহীদ আবু সাঈদ গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঠিক আধা ঘণ্টা আগে মিছিলে অংশ নেওয়ার সময় একই স্থানে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হন মুন। 

পারিবারিক আর্থিক সংকটের কারণে মুন এখনও বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নিতে পারেননি। তার মাথা, মুখ, নাক ও হাতসহ সারাশরীরে এখনও ১৫০টি গুলি রয়ে গেছে। এসব গুলি অপসারণ করে তাকে যন্ত্রণা ও কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে চিকিৎসকরা বিদেশে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়েছেন। 

নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া মুন নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার এসএসসি (ভোকেশনাল) পাস করে ২০২২ সালে রংপুরে আসেন। স্বপ্ন ছিল ভালোভাবে লেখাপড়া করে গরিব মা-বাবার মুখে হাসি ফোটাবেন।

সব আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও মুনের বাবা-মা সামর্থেও অভাবে তাকে দেশের নামকরা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াতে পারেননি। মুন ২০২২ সালে রংপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন। 

এখন সপ্তম সেমিস্টারে পড়ছেন। তার কোর্স শেষ করতে আর মাত্র এক সেমিস্টার বাকি। কিন্তু মুন আদৌ কোর্সটি শেষ করতে পারবে কি না জানেন না। কেননা তার শরীরে এখনও ১৫০টি গুলি রয়ে গেছে।

তীব্র মাথাব্যথা ও সারা শরীরে ব্যথা নিয়ে মুন সবসময় অসুস্থ অনুভব করেন, পড়ায় মনোযোগ দিতে পারেন না, ঠিকমতো ঘুমাতেও পারেন না। এমনকি কখনও কখনও হঠাৎ করে জানা জিনিসও ভুলে যান।

সম্প্রতি আলাপকালে মুন জানান, তিনি নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার পানিয়াল পুকুর পূর্বপাড়া গ্রামের দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। তার বাবা মো. আব্দুল খালেক (৪৫) একজন কৃষক। তার ৬৪ শতক চাষযোগ্য জমি রয়েছে। মা মোছাম্মৎ মুন্নী বেগম (৪০) গৃহিণী।

তার বড় বোন খুশি আক্তার (২৬) নীলফামারী সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ গ্রামের মোহাম্মদ তানভীর জাকারিয়ার (৩২) সঙ্গে ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় বিয়ে হয়। তানভীর জাকারিয়া একজন ফ্রিল্যান্সার এবং বর্তমানে রংপুর শহরের বাস টার্মিনাল এলাকায় ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে থাকেন।

মুনও দুলাভাই তানভীর জাকারিয়ার সঙ্গে রংপুর শহরে থেকে তার সহযোগিতায় পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। খুশি-জাকারিয়া দম্পতির এক মেয়ে তানজিলা (৬) এবং এক ছেলে তোহা (১৮ মাস)।

মুনের অন্য বোন ইতি আক্তার (২২) কিশোরগঞ্জ উপজেলার পান্ডিতপাড়া এলাকার স্কুল শিক্ষক পলাশ মিয়ার (২৮) সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ। এই দম্পতির এক মেয়ে রিফা মনি (৪)।

মুন বলেন, ‘আগের মতো ১৬ জুলাই বিকাল ৩টায় আমাদের রংপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মাঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে অংশ নিতে ছাত্র সমন্বয়কদের পক্ষ থেকে সবাইকে আহ্বান জানানো হয়। ইনস্টিটিউটের ছাত্ররা দুপুর ১২টা থেকেই সেখানে জমায়েত হতে থাকে।’

‘দুপুর ১টায় আমি আমার ক্লাস ক্যাপ্টেন আল বেরুনি রুশোকে বলি, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে আন্দোলনের মিছিল শুরু হয়েছে কি না আমি গিয়ে দেখছি। শাপলা চত্বরে গিয়ে দেখি মিছিল আগেই সেখানে পৌঁছে গেছে, আমি তাতে যোগ দিই।’

মুন তার ক্লাস ক্যাপ্টেনকে জানান, মিছিল শুরু হয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ‘তারপর আমি হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মিছিলে যোগ দিই। দুপুর দেড়টায় মিছিলের সঙ্গে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গেটে পৌঁছি।’

তখন সেখানে বিশাল ছাত্রসমাবেশ হয় এবং বিপুল সংখ্যক পুলিশ গেট আটকে রাখে। ‘আমরা ছাত্ররা পুলিশকে বলি, তারা যেন গেট ছেড়ে দেয়, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরা তাদের আবাসিক হলে ঢুকতে পারে।’

পেছন থেকে ধাক্কাধাক্কির কারণে মুন পুলিশের ওপর পড়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। মুন বলেন, ‘সবাই পিছু হটে। কিন্তু আমি আবার সামনে এগোই, ঠিক তখনই ফ্যাসিবাদী সরকারের মদদপুষ্ট পুলিশ ও তাদের সন্ত্রাসীরা ২টা দশ মিনিট থেকে সোয়া দুইটার মধ্যে একযোগে আমাকে গুলি করে।’

মুন বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও দেখি, চতুর্দিকে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী আর ফ্যাসিবাদী পুলিশের লাঠিচার্জে আবু সাঈদকে নির্মমভাবে পেটানো হচ্ছে।’ মুন গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে ছাত্ররা দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করে।

মুন জানান, ‘কোনো রিকশাচালক আমাকে নিতে রাজি হয়নি। পরে রংপুর সরকারি কলেজের ছাত্র সহাগের মোটরসাইকেলে করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাই। হাসপাতালে পৌঁছার সময় শরীরে ২০০টির বেশি গুলি ছিল, ডাক্তাররা ৪০টি বের করেন। এখনও ১৫০টি গুলি শরীরে রয়ে গেছে। এর মধ্যে মাথায় ৫টি, মুখে ১০টি।’

মুন আরও জানান, ‘আমি তখন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ড-৬-এ একমাত্র আহত ছাত্র ছিলাম। শহীদ আবু সাঈদের শাহাদাতের ৩০ মিনিট পর অসংখ্য আহত হাসপাতালে আসে, কান্না আর আহাজারিতে হাসপাতাল প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।’

মুনের ভাষ্য, ‘চার লাখ টাকা চিকিৎসায় খরচ হয়েছে, কোনো সহায়তা পাইনি। আমি অন্তর্বর্তী সরকারকে আমাকে বিদেশে পাঠিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার অনুরোধ করছি। আমি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবন পেতে চাই।’

তার বাবা আব্দুল খালেকও সরকারের কাছে ছেলের চিকিৎসার ব্যবস্থা করার আবেদন জানান।

মন্তব্য করুন