মেহেরপুর জেলায় বন্যামুক্ত ও ভারী বর্ষণ না থাকায় শীতকালীন সবজি বাঁধাকপি আগাম আবাদ করে সাড়া ফেলেছেন জেলার সবজি চাষিরা। অসময়ে বাঁধাকপি চাষে কৃষকরা একদিকে আর্থিকভাবে যেমন লাভবান হচ্ছেন, অন্যদিকে অর্থকরী ফসল হিসেবে এরই মধ্যে পরিচিত হয়ে উঠছে সবজিটি। অতিপরিচর্যায় আবাদ করা আগাম বাঁধাকপি জেলার সবজির চাহিদা পূরণ করে রপ্তানি করা হচ্ছে বন্যাকবলিত এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
কৃষকরা বলছেন, আধুনিক কৃষি পদ্ধতি ব্যবহার করায় এখন সব ফসলেরই উৎপাদন বেড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় অসময়েও এখন বাঁধাকপির বাম্পার ফলন হচ্ছে। আর অসময়ের এ সবজি বাজারে পাওয়ায় ক্রেতাদের কাছে এর চাহিদাও বেশ ভালো। বর্তমানে বাজারমূল্য ভালো হওয়ায় চাষিরাও লাভবান হচ্ছেন।
কৃষি বিভাগ বলছে, মূলত অল্প খরচ ও স্বল্প সময়ে ভালো ফলন হওয়ার পাশাপাশি অধিক মুনাফা পাওয়ায় মেহেরপুরের অনেক চাষিই এখন বাঁধাকপি চাষে ঝুঁকছেন। শীতকালীন সবজি গ্রীষ্মকালে চাষ করতে এবং তা বাণিজ্যিকীকরণ করতে কৃষি বিভাগ সারা বছর সবজি চাষে কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ ও কারিগরি সহযোগিতা দিয়ে কৃষকদের দক্ষ করে তোলা হচ্ছে।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে মেহেরপুরের তিনটি উপজেলায় প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রকার সবজি আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ৭০০ হেক্টর জমিতে গ্রীষ্মকালীন বাঁধাকপি ও ফুলকপির চাষ হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ৫০ হেক্টর বেশি। মাত্র বছর পাঁচেক আগেই এ গ্রীষ্মকালীন সবজিটির পরীক্ষামূলক চাষ শুরু হয়েছিল এ জেলায়। এরই মধ্যে কৃষকরা শীতকালীন বাঁধাকপি ও ফুলকপি চাষ করে দ্বিগুন লাভবান হচ্ছেন। শুধু কৃষকরাই লাভবান হচ্ছেন এমনটা নয়, জেলার উৎপাদিত বাঁধাকপি ও ফুলকপি যাচ্ছে ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, কুমিল্লা, চাঁদপুর, সিলেট ও চট্টগ্রাম।
গাংনী উপজেলার সাহারবাটি গ্রামের গ্রীষ্মকালীন বাঁধাকপি চাষ করা কৃষক আমরিুল ইসলাম ও আব্বাস আলী বলেন, অথচ বতর্মানে আমাদের মাঠে অনেক সবজির চাষ হচ্ছে। কোনো চাষি যদি ভেবেচিন্তে কৃষি অফিসের পরামর্শ নিয়ে সঠিকভাবে পরিচর্যা করে ফসল ফলান, তাহলে অনেক মুনাফা পাওয়া সম্ভব। আমি এবার তিন বিঘা জমিতে বাঁধাকপির আবাদ করেছিলাম। তাতে সব খরচপাতি বাদ দিয়ে দুই লাখ টাকা লাভ হয়েছে। আমি আগামীতে এ চাষ আরও বেশি করার চিন্তা করেছি।
ভাটপাড়া গ্রামের ফুলকপি চাষি হিরক আলী বলেন, ‘বাঁধাকপি ও ফুলকপি মূলত শীতকালীন সবজি। একসময় এ দুই সবজি শীতকালে আবাদ হতো। আমরা এই সবজিকে এখন অতিপরিচর্যার মাধ্যমে গরমকালে আবাদ করেছি। আমাদের মাঠজুড়ে এখন বাঁধাকপি ও ফুলকপির সমারোহ। তবে এ সবজি চাষে খরচ একটু বেশি। বাজারে এর চাহিদা ও দাম ভালো থাকায় লাভবান হওয়া যায়। এক বিঘা জমিতে কপি চাষ করতে বর্তমানে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। আর এ কপি বড় হওয়ার আগেই জেলার বাইরের ব্যবসায়ীরা এসে প্রতিবিঘা জমির কপি এক লাখ বিশ হাজার টাকা থেকে জমি অনুপাতে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয়ভাবে খুচরা বাজারে এই সবজি বিক্রি করতে পারলেও লাভবান হওয়া যায়।
মেহেরপুর মোনাখালি গ্রামের চাষি দেলোয়ার হোসেন বলেন, গ্রীষ্মকালীন বাঁধাকপির চাষ আমি এ বছরই প্রথম করেছি। আমার দেড় বিঘায় বাঁধাকপির আবাদ করি। এখন তা বিক্রিযোগ্য হয়ে গেছে। একবার বিক্রি করে ৬০ হাজার টাকা হয়েছে। এখনও আশা করছি ৫০ হাজার টাকার বিক্রি হবে।
ষোলমারি গ্রামের রিয়াজুল ও ভিটিরমাঠের জয়নাল আবেদীন জানান, মেহেরপুর জেলায় কোনোদিন বন্যা হয়নি। তেমন বর্ষাও হতে দেখিনি। যে ফসলই আবাদ করি তা ভালো হয়। বিভিন্ন জেলায় বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ হওয়ায় সব সময় সবজি আবাদ হয় না। ফলে এখানকার উৎপাদিত সবজি দুর্যোগপূর্ণ জেলাতে ভালো দামে বিক্রি করতে পারি। এ বছর ওই দুই কৃষক এক বিঘা করে ফুলকপি ও বাঁধাকপির আবাদ করেছিলেন। এখন তা বিক্রির সময়। বিভিন্ন জেলার পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। দাম ও চাহিদা ভালো পাওয়ায় খরচের তিনগুন টাকা লাভ হবে এমন প্রত্যাশা তাদের।
সাহারবাটি বাজারের সবজি ব্যবসায়ী উজ্জ্বল ও আসমাউর হোসেন বলেন, ‘আমরা প্রতিদিনই ট্রাকভর্তি করে কৃষকদের বাঁধাকপি ও ফুলকপি দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠিয়ে থাকি। বর্তমানে অসময়ে আবাদ করা বাঁধাকপি ও ফুলকপির চাহিদা ব্যাপক। দাম ভালো। চাষিরা লাভবান হচ্ছেন।
মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিজয় কৃষ্ণ হালদার বলেন, মেহেরপুরের আবহাওয়া ও জলবায়ু কৃষির জন্য বেশ উপযোগী। এখানে বছরজুড়েই প্রায় সব ধরনের সবজির চাষ হয়ে থাকে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে অধিকাংশ সবজি দেশের বিভিন্ন বাজারে চলে যায়। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে এবার জেলায় ৭০০ হেক্টর জমিতে বাঁধাকপি ও ফুলকপির চাষ হয়েছে। আগামীতে এটি আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করছি। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে আধুনিক কৃষির ব্যবহারসহ উৎপাদিত ফসল বাণিজ্যিকীকরণে কৃষকদের সার্বিক সহযোগিতাও করা হচ্ছে।
মন্তব্য করুন