বাংলাদেশের সর্বপ্রথম রাহুমুক্ত ও অনেক কষ্টে অর্জিত চট্টগ্রাম নন্দনকানন সাংঘিক বৌদ্ধ বিহারের ২০২৪ সালের দানোত্তম শুভ কঠিন চীবর দান উৎসবটি ছিল দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও শ্রেষ্ঠ আয়োজন এবং সাংঘিকের আওতাভুক্ত প্রথম কঠিন চীবর দান।
এবারের কঠিন চীবর দানকে ঘিরে মাসব্যাপী বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে উদযাপন কমিটি। এ উপলক্ষে সাজ সাজ রব বিরাজ করে পুরো চট্টগ্রামজুড়ে। গত ১লা নভেম্বর শুক্রবার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান দানোত্তম কঠিন চীবর দান উৎসব উপলক্ষে চট্টগ্রাম মহানগরীর ডিসি হিল ও নন্দনকানন বৌদ্ধবিহার প্রাঙ্গনে দিনব্যাপী বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অর্চনাসমূহ অনুষ্ঠিত হয়।
ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলাকালীন নগরীর কোতোয়ালি থানার নন্দনকাননসহ চট্টগ্রাম সাংঘিক বৌদ্ধ বিহার,বৌদ্ধ মন্দির মোড় ও ডিসি হিলসহ আশপাশের এলাকায় বিপুলসংখ্যক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ভক্ত দর্শনার্থী ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সমাগম ঘটে।
এ সময় সুষ্ঠুভাবে গমনা গমন ও নিরবিচ্ছিন্ন যান চলাচল নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি ট্রাফিক কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উদ্যোগে চেরাগী পাহাড় মোড়, লাভ লাইন মোড়, এনায়েত বাজার মোড়, বোস ব্রাদার্সের মোড়ে ও পুলিশ প্লাজার সামনে যান চলাচলে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
এদিকে শত বছরের শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্য শতাব্দি প্রাচীন বাংলাদেশের বৌদ্ধদের মহা ঐতিহাসিক পূণ্যতীর্থ এবং সবচেয়ে বড় আয়োজন-সমাগমের কঠিন চীবর দান উৎসবের দুই পর্বের অনুষ্ঠানের মধ্যে প্রথম পর্বে সকালবেলা নন্দনকাননসহ বৌদ্ধবিহার প্রাঙ্গনে ভোর ৬টার সময় বিশ্ব শান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনা ও সূত্রপাঠ অনুষ্ঠান, ৭টা ১ মিনিটে জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন এবং সকাল ১০টায় সময় চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারের প্রথম অধ্যক্ষ ধর্মবংশ মহাথের, দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাথের, শীলাচার শাস্ত্রী মহাস্থবিরসহ ভূতপূর্ব সকল অধ্যক্ষ গণের স্মরণে এবং উপসংঘরাজ শীলানন্দ মহাস্থবির, সংঘবন্ধু অজিতানন্দ মহাস্থবির, উপসংঘরাজ বুদ্ধরক্ষিত মহাস্থবির এবং সম্প্রতি প্রয়াত বান্দরবান আর্যগুহা ধুতাঙ্গ বিমুক্তি বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ড. এফ দীপঙ্কর মহাস্থবির সহ অত্র বিহারের সকল সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ দায়ক দায়িকাদের পারলৌকিক সদগতি ও বাংলাদেশি বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু মহামান্য ত্রয়োদশ সংঘরাজ ড. জ্ঞানশ্রী মহাস্থবিরের নিরোগ দীর্ঘজীবন কামনায় অষ্টপরিষ্কারসহ মহাসংঘদান, জাতীয় বৌদ্ধ সম্মেলন ও ধর্মীয় দেশনা অনুষ্ঠিত হয়।
এ সময় মহান প্রাজ্ঞ ভিক্ষু সংঘের উপস্থিতিতে পবিত্র ত্রিপিটক থেকে মঙ্গলাচরণ পাঠ করেন প্রজ্ঞানিধি শ্রামন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার উপসংঘরাজ শাসন স্তম্ভ ধর্মপ্রিয় মহাস্থবির।
এছাড়াও সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রিয়ানন্দ মহাস্থবির, ধর্মপাল মহাস্থবির, উদযাপন পরিষদের সভাপতি ও উপাধ্যক্ষ একুশে পদক প্রাপ্ত গুণীজন অধ্যাপক ড. জিনবোধি ভিক্ষু, উদযাপন পরিষদের কার্যকরী সভাপতি অধ্যাপক জ্ঞানরত্ন মহাস্থবির, প্রকাশনা পরিষদের চেয়ারম্যান শুদ্ধানন্দ মহাস্থবির, লোকাবংশ স্থবির, পরিষদের অর্থ সম্পাদক প্রিয়রত্ন মহাস্থবির, শীলানন্দ মহাস্থবির, ধর্মতিলক স্হবির, উদযাপন পরিষদের প্রচার ও মিডিয়া চেয়ারম্যান জে.বি.এস আনন্দবোধি ভিক্ষু, বিজয়ানন্দ মহাস্থবির, লোকপ্রিয় মহাস্থবির, করুণানন্দ স্থবিরসহ শতাধিক মহান প্রাজ্ঞ ভিক্ষু সংঘ উপস্থিত ছিলেন।
এরপর বেলা ১.৩০ মিনিটে একটি শান্তি শোভা যাত্রা নগরীর চেরাগী পাহাড় মোড়সহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা প্রদক্ষিণ করার মাধ্যমে উপস্থিত পূর্ণার্থীরাসহ পূজনীয় ভিক্ষু সংঘরা ডিসি হিল প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়ে দ্বিতীয় পর্বের দানোত্তম শুভ কঠিনচীবর দান উৎসব শুরু হয়। শুরুতেই চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহার সাংঘিকের ছোট্ট শিশু কিশোরদের অংশগ্রহণে জয়মঙ্গল অঠ্টগাথা এবং পবিত্র ত্রিপিটক থেকে মঙ্গলাচরণ পাঠ করেন ভদন্ত অগ্রলংকার স্থবির।
বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার উপসংঘরাজ শাসন স্তম্ভ ভদন্ত ধর্মপ্রিয় মহাস্থবিরের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের পিপিএম-সেবা অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মো. আব্দুল ওয়ারীশ। উদযাপন কমিটির সচিব ভদন্ত শাসনবংশ মহাথেরোর সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার সাবেক মহাসচিব, বিচিত্র ধর্মকথিক, বাগ্মী এস লোকজিৎ মহাস্থবির। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রিয়ানন্দ মহাস্থবির, সুমঙ্গল মহাস্থবির, কথাসাহিত্যিক দীপঙ্কর মহাস্হবির, ধর্মবোধি ভিক্ষুসহ শতাধিক মহান ভিক্ষু সংঘ।
এবারের চীবর দান অনুষ্ঠানে রাজকীয় সৌন্দর্যের সমাহার ফুটে ওঠে,অপূর্ব লাইটিং ও অপরূপ সাজসজ্জা এবং বিনয়শীল সংঘের পদচারণায় যেন মনে হচ্ছিল হাজারো দেবতার সাধু ধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে নজরুল স্কোয়ারের ডিসিহিল প্রাঙ্গণ।
তবে এবারের কঠিন চীবর দান ঐতিহাসিক রেকর্ড ও ইতিহাস সৃষ্টি করেছে বিশেষ করে এবারের ডিসি হিলের নজরুল স্কোয়ারে সাদা ড্রেস পরিহিত, বিভিন্ন দানীয় সামগ্রী সাজিয়ে, অষ্ঠ পরিষ্কার সামগ্রী,বৌদ্ধ পতাকা নিয়ে সুসজ্জিত হয়ে বৌদ্ধ প্রতিরূপ দেশের আদলে হাজার হাজার পূণ্যার্থীর ঢল নামলেও কোন বক্তা ছিল না এবং কোন দায়ক দায়িকাকে স্পিকার বা কোন পদ পদবী দেওয়া হয় নাই বিধায় অন্যান্য বৌদ্ধ গ্রাম ও এই নিয়ম অনুকরণ করা শুরু করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উপাসক বলেন, এই বিহার সহ কিছু বৌদ্ধ বিহারে যারা আগে দখল করে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা না থাকলেও বর্তমান কিছু প্রজন্ম তাদের অনুসরণ করে সুযোগ পেলেই অধর্মীয় কার্যকলাপ শুরু করে দেয় অজান্তেই এবং তারা স্থানীয় মানুষদের বোকা বানিয়ে খুবই সুচতুর ভাবে এই কাজগুলো করছে।
তিনি আরও বলেন, কিছু মানুষ নিজেকে মহান হিসেবে প্রমাণ করবার জন্য খুব সহজভাবে ব্যবহার করতে চায় বিহারের পদ পদবী এবং স্পিকার। আবার কিছু টাকা দান করে অনেকেই পদ নেন ও অতিথি হন, যার কারণে আমরা বৌদ্ধ সমাজ পিছিয়ে যাচ্ছি দিনকে দিন এবং কোন্দল ও সংকট বেড়েই চলছে প্রতিটা বৌদ্ধ বিহারে।
জগতের সকল ধর্ম ও সম্প্রদায় তথা সকল প্রাণীর মঙ্গল কামনা করে বিকেল ৫টায় কঠিন চীবর উৎসর্গ করে আনুষ্ঠানিকভাবে ডিসি হিলের চীবর দান অনুষ্ঠান সমাপ্ত ঘোষণা করার মাধ্যমে রাতে বিহার প্রাঙ্গনে ভান্ডারগাঁও কীর্তনীয়া ফোরামের শিল্পী ডাক্তার বিধানচন্দ্র বড়ুয়া ও অক্ষয় বড়ুয়ার একটি মনোজ্ঞ বুদ্ধ কীর্তন পরিবেশনার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের শুভ সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
মন্তব্য করুন