গতকাল ৮ জুন শনিবার সকাল থেকেই দারুণ উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে নূতন প্রজন্মের বিতার্কিকেরা মেতে উঠেছে শাণিত যুক্তি, বুদ্ধির দীপ্তি আর বাক্শৈলীর প্রয়োগে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে ‘পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতা’য় চূড়ান্ত বিজয়ের গৌরব অর্জন করার লড়াইয়ে। চাঁদপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে সকাল ৭টায় বিতার্কিকদের রেজিস্ট্রেশনের পর টসের মাধ্যমে পক্ষ-বিপক্ষ নির্ধারণের পর পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, পবিত্র গীতা পাঠ ও সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের পর শুরু হয় উল্লাস তথা ফাইনাল পর্ব। একে একে পাঁচটি বিতর্কে ১০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিতর্কাকিরা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের লড়াই করে চ্যাম্পিয়ন কিংবা রানার্স আপ হয়। প্রতিটি বিতর্কই বিতার্কিকদের যুক্তি-পাল্টা যুক্তির উপর ভিত্তি করে প্রাণবন্ত হয়ে উঠে।
সর্বপ্রথম শুরু হওয়া কলেজ পর্যায়ের বিতর্কের বিষয় ছিলো : ‘অবকাঠামোগত উন্নয়নের চেয়ে সাংস্কৃতিক উন্নয়ন অধিকতর টেকসই’। এই বিতর্কে বিষয়ের পক্ষে অংশ নেয় চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজ ও বিপক্ষে চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ। টানটান উত্তেজনাপূর্ণ এ বিতর্কে নিজেদের ক্ষুরধার বিতর্ক উপস্থাপনের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্বের গৌরব অর্জন করে চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ। দলটি প্রথমবারই পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বাজিমাত করলো। ৬.৫ নম্বরের ব্যবধানে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে। শ্রেষ্ঠ বক্তা নির্বাচিত হন বিজয়ী দলের দলপ্রধান মোঃ সৌরভ হাসান।
সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে শুরু হয় প্রাথমিক পর্যায়ের জমজমাট বিতর্ক প্রতিযোগিতা। বিতর্কের বিষয় ছিলো : ‘শিশুর নির্মাণে বিদ্যালয় নয় পরিবারই মুখ্য’। হাজীগঞ্জ বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ফরিদগঞ্জ ইক্রা মডেল একাডেমির মধ্যকার প্রতিযোগিতাটি ছিলো অত্যন্ত প্রাণবন্ত। এ বিতর্কে জেলায় শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা লাভ করে ফরিদগঞ্জ ইক্রা মডেল একাডেমি। প্রতিপক্ষকে ১৮ পয়েন্টের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে দলটি। শ্রেষ্ঠ বক্তা নির্বাচিত হন বিজয়ী দলের প্রথম বক্তা উম্মে আইমুন লামিছা।
‘এ সংসদ মনে করে জনস্বার্থে ফেসবুক নিষিদ্ধ করা হোক’ বিষয়ে ৯টা ৪৫ মিনিটে শুরু হয় সংসদীয় ধারার বিতর্ক। এতে সরকারি দল ছিলো চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় এবং বিরোধী দল ছিলো চাঁদপুর সরকারি কলেজ (উন্মেষ) দল। এ বিতর্কে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট অর্জন করে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়। শ্রেষ্ঠ বক্তা নির্বাচিত হন বিজয়ী দলের মন্ত্রী তাজনীন তাজ ছোঁয়া। এ বিতর্ক দলটি এবারই প্রথম পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে আশাব্যঞ্জক সাফল্য দেখালো।
বেলা ১১টা ১০ মিনিটে শুরু হয় ইংরেজি মাধ্যম বিতর্ক। এ বিতর্কে অংশ নেয় মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, চাঁদপুর। ‘উইন্টার ইজ বেটার দ্যান সামার’ বিষয়ে প্রাণবন্তভাবে দুটি দলই সাবলীলভাবে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করে। এ বিতর্কে মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়কে মাত্র ৬ নম্বরের ব্যবধানে হারিয়ে বিজয়ী হয় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, চাঁদপুর। শ্রেষ্ঠ বক্তা নির্বাচিত হন বিজয়ী দলের দলপ্রধান প্রত্ন পীযূষ বড়ুয়া।
শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে সবশেষে শুরু হয় মাধ্যমিক পর্যায়ের বিতর্ক। দুপুর ১২টায় শুরু হওয়া এ বিতর্কে বাবুরহাট স্কুল এন্ড কলেজকে ১৬ নম্বরের ব্যবধানে হারিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা লাভ করে হাজীগঞ্জ উপজেলার বলাখাল চন্দ্রবান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। এ দলের দলপ্রধান রাওয়ান ছুবহা শ্রেষ্ঠ বক্তা নির্বাচিত হন। বিতর্কের বিষয় ছিলো : প্রজন্মের শিক্ষায় জ্ঞান নয় নৈতিকতাই অধিক জরুরি।
প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ দলকে সার্টিফিকেটসহ নগদ অর্থ ও বই পুরস্কার হিসেবে প্রদান করা হয়। পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ।
পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিঃ-এর প্রকাশক কামরুল হাসান শায়কের সভাপ্রধানে বিশেষ অতিথি ছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও প্রাবন্ধিক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর, চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র অ্যাডঃ জিল্লুর রহমান জুয়েল, জেলা কালচারাল অফিসার দিতি সাহা, চাঁদপুর কণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা, সম্পাদক ও প্রকাশক আলহাজ্ব অ্যাডঃ ইকবাল-বিন-বাশার এবং চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন একসময়ের তুখোড় বিতার্কিক ও চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমির উপাধ্যক্ষ রাসেল হাসান।
বিতর্কের বিভিন্ন পর্বে সভাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন পাবনা সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর বিলকিস আজিজ, চাঁদপুর জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা কাউছার আহমেদ, চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমির অধ্যক্ষ ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া ও চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক ফারহানা আক্তার। সংসদীয় ধারায় স্পীকারের দায়িত্বপালন করেন ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া।
প্রতিযোগিতায় বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক রাধ্যেশ্যাম কুরী, অধ্যাপক মোঃ আবুল কালাম, অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া, এএইচএম আহসান উল্লাহ, সামীম আহমেদ খান, হাবিবুর রহমান পাটওয়ারী, রাসেল হাসান, মুক্তা পীযূষ, মোঃ সাইফুল ইসলাম, কাজী শামীম ও আনাছ আল জায়েদ। মডারেটর ও সময় সংরক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন সৈকত অধিকারী, কাজী আজিজুল হাকিম নাহিন, শামীম হাসান ও শৈলী দাস।
‘বিতর্কে আজ নতুন জোয়ার, যুক্তিতে যুগ খুললো দুয়ার’ স্লোগানে ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো এ বিতর্ক প্রতিযোগিতা। কিন্তু করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে প্রতিযোগিতাটি ২০২৩-২০২৪ সালে বাস্তবায়ন করা হয়। বিতর্কে সনাতনী ধারায় প্রাথমিক পর্যায়ে ৩২টি দল, মাধ্যমিক পর্যায়ে ৭২টি দল, কলেজ পর্যায়ে ৩০টি দল, ইংরেজি মাধ্যমে ৮টি দল এবং সংসদীয় ধারায় ৮টি দল অংশগ্রহণ করে।
২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতার উল্লাস পর্ব শেষে ২০২৫ সালের স্লোগান উন্মোচন করেন অতিথিবৃন্দ। আগামী বছরের স্লোগান : ‘স্মার্ট যুক্তি স্মার্ট দেশ, মুক্তবুদ্ধির বাংলাদেশ’।
মন্তব্য করুন