শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যরাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াফিচারশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১

শামসিয়া হাসানি

আফগানিস্তানের প্রথম নারী গ্রাফিতি-শিল্পী

প্রবাহ বাংলা নিউজ
  ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০৬

গ্রাফিতি- এক ভিন্নধর্মী চিত্রাঙ্কন মাধ্যম। বৈশিষ্ট্যে, রঙে, আঁকার ঢঙে, দ্যোতনায়- সবকিছুতেই তা চলমান যেকোনো ছবির চেয়ে আলাদা। জল বা তৈলচিত্র, কিংবা চারকোল পেইন্টিংয়ের চেয়েও দ্বিগুণ শক্তিতে যেন নজর কাড়ে গ্রাফিতি।
কাগজে কিংবা বোদ্ধাশ্রেণীতে সীমিত নয় গ্রাফিতি। গোটা পৃথিবীই যেমন গ্রাফিতির ক্যানভাস, তেমনি সকল মানুষের জন্য উন্মুক্ত এই চিত্র। অর্থাৎ, গ্রাফিতি কোনো নির্দিষ্ট কাগজ বা ছোট আকৃতির মাধ্যমে নয়, বরং দেয়ালে বা স্থাপনায় অঙ্কিত হয়। আর এর ফলে গ্রাফিতি সবারই চোখে পড়ে, সবাই এর দর্শক।

সুসজ্জিত দেয়ালে কিংবা কোনো অপূর্ব স্থাপনার একটি অংশ জুড়ে বা  অন্যান্য শোভনীয় স্থানে গ্রাফিতি কম-বেশি আমাদের সকলের চোখেই পড়েছে। বিবর্ণ, নষ্ট, বিধ্বস্ত দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতিকে দ্বিগুণ প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কখনো শোভা পেতে দেখেছেন?

এই জনরাঁর গ্রাফিতি শিল্পীরা পরম মমতা ও প্রতিবাদের মিশেলে যেন দুর্যোগের দুঃসহ স্মৃতিকে মলিন করবার প্রয়াসে দেয়ালকে রাঙিয়ে তোলেন। শামসিয়া হাসানিও এদেরই একজন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তানকে এই মানুষটি রঙিন করে তুলেছেন তার উজ্জ্বল শিল্পকর্ম দিয়ে। 

কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার সহকারী অধ্যাপক এই শামসিয়া হাসানি। যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর কাবুলের ভাঙা, বিবর্ণ দেয়াল এবং স্থাপনাগুলোতে গ্রাফিতি এঁকে চারিদিকে ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করেছেন। সজীব করে তুলেছেন তার দেশ আফগানিস্তানকে। বিখ্যাত এই পথচিত্রশিল্পী বলেন,
আমি গ্রাফিতির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে যুদ্ধের নির্মম-ভয়ঙ্কর সব স্মৃতি মুছে দিতে চাই। আর যদি আমি তা মুছে দিতে সক্ষম হই, তাহলে মানুষ রঙিন স্বপ্ন দেখবে নিজের দেশকে নিয়ে। আমি চাই বিশ্বের মানুষ আফগানিস্তানকে চিনুক তার শিল্পের জন্য; তার যুদ্ধের জন্য নয়।

আফগানিস্তানের কান্দাহারে যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় যখন ইরানের তেহরানে চলে যায় শামসিয়ার পরিবার, সেই বছর অর্থাৎ ১৯৮৮ সালে শামসিয়া হাসানির জন্ম হয়। শৈশবকাল থেকেই ছবি আঁকায় দারুণ উৎসাহ ছিল তার। ইচ্ছে ছিল চারুকলাতেই পড়াশোনা করার। কিন্তু তেহরানে, একজন আফগান হয়ে এই স্বপ্ন তিনি পূরণ করার সুযোগ পান না।
অতঃপর শামসিয়া তার পুরো পরিবারের সাথে আফগানিস্তানে ফিরে আসেন এবং কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলায় স্নাতক এবং ভিজুয়াল আর্টসে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ড্রয়িং অ্যান্ড অ্যানাটমি ড্রয়িংয়ের প্রভাষক পদে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিযুক্ত হন।

দেয়ালে দেয়ালে উজ্জ্বল রঙের বিভিন্ন অর্থবহ পথচিত্র অঙ্কনের পেছনে তার উদ্দেশ্য ছিল সংগ্রাম কিংবা হিংস্রতার বদলে দেশের মাধুর্য এবং কারুশিল্পের দিকে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ। ‘আর্ট-বায়ো’র একটি সাক্ষাতকারে তিনি বলেন,
আমার তুলির আঁচড়ে আমি মানুষের মন থেকে যুদ্ধ সম্পর্কিত সব ক্ষত চিরতরে মুছে দিতে চাই।

শামসিয়া হাসানির আঁকা পথচিত্রগুলোর দিকে যদি লক্ষ্য করা যায়, তাহলে একটা দিক খুব চোখে পড়ে। আর তা হলো নারী। তার সকল পথচিত্রেই প্রাধান্য পেয়েছে নারীমূর্তি। শুধু নারী নয়, বরং নারী শক্তি। ‘আর্ট-র‍্যাডার’ নামক একটি জার্নালে শামসিয়া ব্যাখ্যা করেন তার বিষয়বস্তুর কারণ। তিনি বলেন,
আফগানিস্তানে একজন নারী হয়ে বড় হয়ে ওঠা সহজ কথা নয়। যুদ্ধপ্রবণ দেশে একজন নারীর কষ্ট কেউ অনুভব করতে পারে না। তাকে অনেক দুর্দশার মধ্য দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে হয়, চারপাশকে রক্ষা করতে হয়। তাই তিনি নারীশক্তির আনন্দটিকে ফুটিয়ে তুলতে চান তার রঙ-বেরঙের গ্রাফিতির মাধ্যমে। বিশেষ করে মুসলিম আফগান নারীদের ভিন্ন প্রতিমূর্তি নিদর্শন করাই তার পথচিত্রের একমাত্র লক্ষ্য।

শুধুমাত্র নারীশক্তি ছাড়াও শামসিয়ার শিল্পকর্মে স্থান পেয়েছে ইসলামি ঐতিহ্যের দিকটি। গ্রাফিতিগুলোতে দেখা যায়, প্রত্যেক নারীই বোরকা অথবা হিজাব পরিহিত অবস্থায় গিটার বাজাচ্ছে, পিয়ানো বাজাচ্ছে, পথেঘাটে স্বাধীনভাবে চলাচল করছে।

অর্থাৎ মুসলিম নারীর পোশাক যে তার জন্য কোনো বাঁধা সৃষ্টিকারী নয়, বরং সেই পোশাকেই একজন মুসলিম নারী আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেন, নিজস্ব পরিচিতি তৈরি করতে পারেন, সমান অধিকারী হতে পারেন সবকিছুর- সেটিকেই তুলে ধরা হয়েছে।

অনেকেই মনে করেন, পর্দাপ্রথা একজন মুসলিম নারীকে শোষণ করার মাধ্যম, পিছিয়ে রাখার উপায় ইত্যাদি। এই ধারণাটিকে প্রত্যাখ্যান করেন শামসিয়া। তার মতে,
একজন আফগান নারীকে দৈনিক নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন: নারীরা লেখাপড়ার ক্ষেত্রে সম-অধিকার থেকে বঞ্চিত, যা হিজাব-বোরকার চেয়ে অনেক বড় একটা সমস্যা।

ক্ষত-বিক্ষত দেয়ালে শামসিয়া হাসানির আঁকা গ্রাফিতিগুলো দেখলে মনে হবে দেয়ালগুলো যেন প্রাণ পেয়েছে। চারপাশে আলো ছড়াচ্ছে, দীপ্তিমান একেকটা গ্রাফিতিচিত্র। পিয়ানো অথবা গিটার হাতে বোরকা পরা নারীর গ্রাফিতিগুলো আমাদের এই বার্তাই দেয় যে, আফগান নারীরা যুদ্ধ-পরবর্তী অবস্থায় নিজেদের আত্মশুদ্ধি করছে। নিজেদের ঘরে আবদ্ধ না রেখে আত্মবিশ্বাস এবং আত্মমর্যাদায় তারা এখন দৃপ্তপায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

শামসিয়ার চিত্রে নারীরা শক্তিমান এবং স্বাধীন। তারা উজ্জ্বল এবং কঠিন। তারা ধর্ম এবং স্বাধীনতাকে একত্রে বহন করে। ধর্মকে পুঁজি করে নারীদের পথে যে বাঁধা সৃষ্টি করা হয়, আফগান নারীরা এখন তা প্রতিহত করতে পারে। শামসিয়া হাসানি বিশ্ববাসীকে এই বার্তা দিতে চান যে,
আফগান নারীরা দ্বিগুণ শক্তিতে ফিরে এসেছে যুদ্ধবিদ্ধস্ত আফগান সমাজে। তারা নতুন। তারা নতুন উদ্যমে আবার শুরু করবে তাদের যাত্রা।

এখন দেখা যাক, স্ট্রিট আর্ট এবং গ্রাফিতিতে তার যাত্রাটি কেমন ছিল। ২০০৯ সালে তিনি দশটি সমসাময়িক কলা পুরস্কার অর্জনকারী শীর্ষ শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তিনি ২০১০ সালে একটি কর্মশালায় অংশ নেওয়ার পর গ্রাফিতির প্রতি আকৃষ্ট হন। সেই থেকে রয়ে যান শিল্পমাধ্যমের এই শাখাতেই। এখানেই শেষ নয়, শামসিয়া ‘বেরঙ আর্টস অর্গানাইজেশন’ এর ৯ জন সদস্যের মধ্যে অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও বটে।    

মুখে মাস্ক বেঁধে, হাতে দুই-চারটি স্প্রে পেইন্ট নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গ্রাফিতি আঁকতেন শামসিয়া। এর আগে তিনি যেখানে আঁকবেন, সেইসব স্থাপনা দেখে আসতেন, একটি ড্রাফট করে প্রিন্ট করতেন সেই হাতে আঁকা ছবিটি। তারপর সেই প্রিন্টেড ছবি হাতে নিয়ে যথাস্থানে পৌঁছে তিনি আঁকতে শুরু করতেন।
যেমনটি ওপরে বর্ণিত হয়েছে যে, আফগানিস্তানের একজন নারী হওয়া শক্ত, শামসিয়া তাদের মধ্যে অন্যতম যিনি নিয়মিতভাবে সেই হিংস্রতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। তিনি যখন রাস্তায় দেয়ালে গ্রাফিতি করতেন, লোকেরা তাকে গালিগালাজ করতো, হুমকি দিতো, বিভিন্ন রকম ভয় দেখাতো।

জনগণের হয়রানি এবং ‘ইসলামবিরোধিতা’র ফতোয়া এড়াতে, তাকে ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে কাজ শেষ করতে হতো। এমনকি প্রায়শই নিজের চিত্রকর্ম অসম্পূর্ণ রেখে জীবন হাতে নিয়ে পালাতে হতো শামসিয়াকে। কারণ দলবেঁধে তাকে প্রহার করতে ছুটে আসার লোকও কম ছিল না! তবুও তিনি গ্রাফিতি আঁকা বন্ধ করেননি। আশপাশের লোকেরা তার ওপর হামলার ঘটনা দেখে এই সমস্ত কিছু বন্ধ করার উপদেশ দিলেও তার পরিবার সবসময় তাকে সমর্থন যুগিয়ে গেছে।

তিনিই প্রথম আফগান নারী গ্রাফিতি শিল্পী। তিনি তার নামের অর্থ, সূর্য (শামসিয়া)-এর মতোই দীপ্তিময় করে চলেছেন তার প্রিয় শহর কাবুলকে। কাবুল শহরে কোনো গ্যালারি নেই, নেই কোনো প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও। তাই কাবুল শহরটাকেই ক্যানভাসে পরিণত করে, প্রতিনিয়ত প্রদর্শনী করে চলেছেন এই ব্যতিক্রমী চিত্রশিল্পী শামসিয়া।

তার প্রতিভার এসব নিদর্শন আফগানিস্তানের বাইরে আরও প্রদর্শিত হয়েছে ভারত, ইরান, জার্মানি, আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, তুরস্ক, ভিয়েতনাম ইত্যাদির দেশে। এই বিপ্লবী নারী তার প্রতীকী শিল্পকর্মের মাধ্যমে তার শিল্পগত উপায়ে বিশ্বে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।   

২০১৩ সালে কাবুলে তিনিই প্রথম ‘জাতীয় গ্রাফিতি উৎসব’ আয়োজন করেন। ২০১৪ সালে শামসিয়াকে ‘শীর্ষস্থানীয় ১০০ বিশ্বচিন্তাকের একজন’ খেতাব দেয় এফপি। ভারতের গোয়াতে ২০১৭ সালে ‘আর্ট স্পেক্ট্রাম অ্যাওয়ার্ড সাউথ এশিয়া’তে ভূষিত হন তিনি।

হাজারও অস্থিতিশীলতা ও রক্ষণশীলতায় ক্লিষ্ট আফগানিস্তানের অনেক শিক্ষিত নাগরিকই আজকাল দেশের দুরাবস্থা দেখে অন্য দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। শামসিয়া হাসানির আফসোস, এই সম্পদশালী মানুষগুলো যদি নিজ দেশ ত্যাগ না করতো, তাহলে তারা হয়তো নতুন এক আফগানিস্তানের জন্ম দিতে পারতো। শামসিয়া হাসানি তার দেশকে ভালোবাসেন। তিনি আফগানিস্তানকে উন্নত দেখতে চান, এ দেশের নারীদের জন্য কিছু করতে চান। তার পক্ষে যতটুকু সম্ভব, তিনি করেও যাচ্ছেন।

অনেক সময় মুখের কথা খরচ করার চেয়ে নির্বাক ছবির ধার হয়তো অনেক বেশি। তাই সেমিনার, প্রদর্শনী, চিত্রকর্মের মাধ্যমে নিজের শিল্পকর্ম দিয়েই তিনি তুলে ধরছেন ইতিবাচক পরিবর্তনের এসব বার্তা। ছড়িয়ে দিচ্ছেন স্বাধীনতার সুবাস। দৃঢ় প্রত্যয় তার কণ্ঠে, হয়তো আমি আমার দেশকে বিখ্যাত করে তুলবো শিল্পের পরিচয়ে; যুদ্ধের পরিচয়ে নয়।

মন্তব্য করুন