জুতার সামনের অংশটা ছেঁড়া, পেছনের চামড়াটা উঠে গিয়েছে, আর নিচের সোলটা বেঁকে গেছে এমনভাবে, যেন প্রতিদিনকার ক্লান্ত হাঁটার চাপ সেখানে নিজের গল্প এঁকে রেখেছে। সেই পুরোনো জুতাজোড়া—যা কেউ আজ আর চোখে তোলে না—একদিন ছিল হাসিবের বাবার নীরব সঙ্গী।
প্রতিদিন সকাল আটটায় সেই জুতাজোড়া পায়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়তেন বাবা। শীত, বৃষ্টি কিংবা কড়া রোদ—প্রকৃতি যতই কঠিন হোক, বাবার ছায়া প্রতিদিন বাইরে যেতো সংসারের তরে, সন্তানের তরে।
ছোটবেলায় হাসিব বাবার জুতার খটখট শব্দে বিরক্ত হতো। ভেবে নিত, বাবা যেন শুধু ঘরের বাইরে থাকতে ভালোবাসে। কখনো জিজ্ঞেস করেনি—"বাবা, এত পরিশ্রম কেন করো?"
বছর পেরিয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পড়তে সে এখন শহরের ব্যস্ত জীবনে অভ্যস্ত। একদিন বাড়ি ফিরে বাবার ঘরে ঢুকে পড়ল। আলমারির এক কোণায় ঝুলে থাকা জুতাজোড়া দেখে থমকে দাঁড়ায়।
জুতার গায়ে জমে থাকা ধুলো, ছেঁড়া অংশে জমে থাকা সময়ের গা-ছোঁয়া কষ্ট—সব মিলিয়ে যেন একটা ছবি আঁকা আছে। চোখ বন্ধ করতেই মনে পড়ে গেল বাবার সেই কথাগুলো—
“এই জুতাজোড়া কিনেছিলাম তোকে স্কুলে ভর্তি করানোর আগে। ঘরে তখন চাল কেনার টাকাটাও ছিল না। নিজের নতুন পাঞ্জাবি কেনা বাদ দিয়ে এই জুতাগুলো কিনেছিলাম, যেন তোকে স্কুলে দিতে পারি। জানিস, বাবা, এই জুতা পায়ে দিয়েই অনেক রাত কেটেছে—পায়ে ফোটা, ব্যথা, ধুলা—সব কিছু পেছনে রেখে শুধু একটা স্বপ্ন দেখতাম—তুই মানুষ হবি, আমার মতো গরিব হবে না।”
হাসিব আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। অঝোরে কাঁদতে থাকে। সেই জুতাজোড়া দু’হাতে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে। একসময় বাবা বলতেন—“জুতার যত্ন নে, মানুষ যত্ন নিতে শিখে।” অথচ সে নিজেই বাবার যত্ন নিতে শিখল না কখনো।
জানালার ধারে দাঁড়িয়ে হাসিব ফিসফিস করে বলে, “বাবা... আমি জানি না জান্নাতে এই জুতাজোড়া থাকবে কি না। কিন্তু যদি থাকে, আমি সেই জুতা দুটো পায়ে গলিয়ে শুধু একবার তোমার পথ ধরে হাঁটতে চাই। কারণ আজ বুঝি, সেই ছেঁড়া জুতা ছিল আমার জান্নাতের রাস্তাটা তৈরি করার একমাত্র সেতু...”
বিকেলের নরম রোদ জানালার পর্দা ছুঁয়ে মুখে পড়ছিল, কিন্তু হাসিবের চোখ ছিল অশ্রুসজল। রাত নেমে আসে। রাজশাহীর বাতাসে তখনো হালকা শীত। পরদিন সকালে সে উঠে পড়ে—বাবার স্মৃতি ধরে রাখতে, নিজেকে খুঁজে পেতে একা হাঁটতে থাকে শহরের চেনা গলি ধরে। পদ্মার চরে গিয়ে দাঁড়ায় সে—যেখানে একসময় বাবা তাকে নিয়ে বসেছিলেন, আর বলেছিলেন—
“পদ্মার পানি যেমন ধীরে ধীরে কিন্তু নির্ভরযোগ্যভাবে এগোয়, জীবনের পথও তেমনই—ধৈর্য নিয়ে হাঁটলে আল্লাহ সফলতা দেন, বাবা।”
তারপর হাঁটতে হাঁটতে যায় সাহেববাজার। ছোটবেলায় এই বাজারেই বাবা তাকে নিয়ে আসতেন—ছেলেবেলায় একবার একটা খেলনা গাড়ি কিনে দেননি বলে কেঁদে ফেলেছিল সে। এখন সেই বাজারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মনে হলো—"আজ যদি বাবা হতেন, আমি নিজেই তাঁকে একটা নতুন জুতা কিনে দিতাম।"
শেষ বিকেলে সে যায় বরেন্দ্র রিসার্চ জাদুঘরের সামনে। সেখানে বসে বাবার চিঠির মতো একটি চিরকুট লেখে—
“বাবা, তোমার জুতা আমি রেখেছি। শুধু জুতা নয়—তোমার সব পরিশ্রম, ভালোবাসা, ঘামের গন্ধ—সবকিছু আমি বুকের মাঝে চিরতরে নিয়ে রেখেছি। তুমি দোয়া করো, আমি যেন জান্নাতি সন্তান হতে পারি। কারণ রাসূল (সাঃ) বলেছেন—‘যে ব্যক্তি পিতা-মাতার সন্তুষ্টি অর্জন করে, সে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে।’ আমি আজ বুঝেছি, বাবা... আজ সত্যিই বুঝেছি।”
চিরকুটটা সে পদ্মার জলে ছুঁড়ে দেয় না, বুকের পকেটে রেখে দেয়—কারণ তার কাছে সেটাই যেন বাবার শেষ অক্ষর, ‘বাবার জুতার শেষ চিঠি’।
শেষ দৃশ্য
রাজশাহীর সাগরপাড়া কবরস্থানের এক কোনে দাঁড়িয়ে হাসিব। মাথায় টুপি, হাতে বাবার পুরোনো সেই জুতাজোড়া। চুপচাপ দোয়া পড়ে। আকাশটা নীল, বাতাসটা ভারী। চোখের কোণে অশ্রু জমে আছে।
হঠাৎ সে বলে ওঠে— “বাবা, তুমি যেখানেই থাকো, আমি তোমার সেই ছেঁড়া জুতার পদচিহ্ন ধরে জান্নাত পর্যন্ত হাঁটতে চাই। কারণ আমি জানি, পিতার সন্তুষ্টিই সন্তানের প্রকৃত সৌভাগ্য।”
মন্তব্য করুন